নতুন চাকরীতে ঢোকার পর মনে হলো এবার একা একটা বাসা নেওয়া যায়। এত টাকা বেতন দিয়ে কী করবো? ঘোরাঘুরির নেশা নেই, ফাস্ট ফ্যাশনে আগ্রহ নেই, ফাস্ট ফুড পেটে সহ্য হয় না, বন্ধু বান্ধব নেই (হলেও অবশ্য টেকে না), এমনকি বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ নেই যে মাসে মাসে টাকা পাঠাবো। তাই ভাবলাম একা একটা বড় বাসা নেই। 

নিয়েও নিলাম।  

বাড়ির নাম Angina। এই নামে টেকনিক্যাল একটা ভুল আছে। আমার ধারণা, বাড়ির মালিক বোঝাতে চেয়েছেন আঙ্গিনা-কিন্তু লিখে ফেলেছেন অ্যানজাইনা, মানে বুকে ব্যাথা। অবশ্য নামের বানানের ভুল ধর্তব্য নয়। কেউ যদি নার্গিসের বদলে নিজের নাম ‘নার্গীষ’ বলেন বা লিখেন, সেখানেও ভাষাবিদরা ভুল ধরতে পারবেন না।

ইন্দিরা রোডে স্বপ্নের সাথে লাগোয়া আঙ্গিনা, ওরফে অ্যানজাইনা ভবনের আট তলায় দক্ষিণ দিকের বিশাল ফ্ল্যাটটা আমার। তিন বেডরুম, দুই ওয়াশরুম, প্রকান্ড এক ড্রয়িং ডাইনিং। সকাল বেলা আসে কড়কড়ে রোদ আর রাতে উজাড় করা বাতাস। একটা ব্যাপার মনে পড়লেই বুকে চিনচিন করে সুখের মতো অনুভব  হয়। এই বাসায় বাথটাব আছে। বাথটাবে শুয়ে আমি ডাল্টন ট্রাম্বো আর অগাথা ক্রিস্টি পড়ি। কারণ এরা লিখতেন বাথটাবে শুয়ে-বসে। বাথটাবে লেখা বই বাথটাবে শুয়ে পড়লে লেখকের আত্মা শান্তি পায়। 

এই মুহূর্তে পড়ছি ট্রাম্বোর Jhonny got his gun, অ্যান্টি ওয়্যার বোরিং উপন্যাস। জো বনহ্যাম নামে এক ভদ্রলোক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গিয়ে অন্ধ, মূক-বধির হবার পাশাপাশি হাত-পা-ও হারায়। এসব সেন্টিমেন্টাল মোরালিস্ট লেখা আমাকে টানে না। পড়তে গিয়ে কিছুক্ষণ পরপর হাই তুলি। আমি ওয়্যার রোমান্টিক মানুষ, কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে শুনলে ভালো লাগে।

এই বাসাটা নেবার সময় বাড়িওয়ালার সাথেও ওয়ান টু ওয়ান কনভারসেশনাল যুদ্ধ হয়েছে। ফাকিং বোরিং। হাফ প্যান্ট পড়া থলথলে পেটের বাল পাকনা (পাকা চুলের) এক লোক কড়কড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

‘নাম কী?’ 

‘ফিদিয়া’ 

‘ফিদিয়া তো খ্রিস্টান নাম মনে হয়, শূকর খাও না তো?’ 

‘না’

‘ফ্যামিলি থাকবে?’ 

‘না’ 

‘কিছু মনে কোরো না। আমরা মেস ভাড়া দেই না। এরা খুব ঝামেলার হয়।’ 

‘মেস না, একাই থাকবো’ 

‘একদম একা?’

‘জি’

‘ছেলেটেলের কাহিনী থাকলে ডাইরেক্ট পুলিশ। আমার ছোটভাই এখন ফার্মগেট থানার ওসি। এসব কাহিনীতে নো কম্প্রোমাইজ। যে বাড়িতে অনৈতিক কাজ হয় সেই বাড়ির কোনো উন্নতি হয় না’

 ‘ঠিক আছে’ 

আরও নয়শো প্রশ্নের যথাসম্ভব বাইনারিতে উত্তর দেবার পর তিনি শেষমেষ বাসা ভাড়া দিলেন। বাড়ি ভাড়া না, মনে হলো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। এনআইডি, চারিত্রিক সনদ থেকে শুরু করে যা যা আছে সবকিছুর ফটোকপি নিলো। এক প্রকার জোর করেই এসএসসি এইচএসসির সার্টিফিকেটও জমা দিলাম। রাখবি যখন সবই রাখ হারা*মজাদা।  

শুরুর দিকে বাড়িওয়ালা এবং দারোয়ান দুজনই আমার উপর বাড়তি নজরে রাখতো। মেয়েদের কম্পাউন্ড আই, মানে চারদিকে চোখ। কে কখন কোনদিকে কীভাবে তাকায় এরা সব টের পায়। আমিও পাই। এখন অবশ্য ওরা আর তেমন ঘাটায় না। কোনো ছেলে দূরের কথা-কোনো মেয়ে, শিশু, বৃদ্ধ, এমনকি অসুস্থ মানুষও আমার বাসায় আসে না। আমার কোনো পোষা পাখি নেই, বিড়াল নেই, কুকুর নেই, গাছ নেই, অ্যাকুয়ারিয়াম নেই। অফিস থেকে ফিরি যথাসম্ভব রাত করে। অফিসের কেয়ারটেকার ছেলেটি-যাকে প্রায়ই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলে মনে হয়- রাত আটটার পর থেকে আমার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকানো শুরু করে। কারণ আমি বের না হলে তারও বের হতে দেরি হয়।

অফিসে এক সিনিয়র আপা প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, 

ফিদিয়া, বাসায় যান না কেন?
বিয়ে করেন না কেনো?
হাসেন না কেনো?
ওজন কমছে কেন?-সহ আরও নানা বুলশিট প্রশ্ন। 

এত কেন’র উত্তর আমার কাছে নেই। এরপর থেকেই আমি উনাকে দেখলেই মিট অ্যান্ড রান মেথডে চলি। দেখামাত্রই উল্টাঘুরে দৌড়। ‘মিট অ্যান্ড রান’ হলো রিদমিকালি ‘হিট অ্যান্ড রান’ এর চাচাতো ভাই। নিজস্ব এই ফ্রেজের চর্চা এতটাই বহাল যে, ওই আপাকে এড়ানোর জন্য একবার ওয়াশরুমে দুই ঘণ্টা টানা কাটিয়েছি। 

ছুটির দিনগুলোতে আমার অবশ্য বেশ হাঁসফাঁস  লাগে। আগেরদিন ডিনারের পর দ্রুত ডিসোপ্যান বা রিভোট্রিল খাই। ১ মিলিগ্রাম। ঘুম ভালো হয়, এরচেয়েও বড় কথা, ঘুম থেকে উঠে দেখি ২ টা বাজে। বাথটাব কিচেন মিলে বাকি সময় কেটে যায়।

আমার ফ্ল্যাট নাম্বার এইট-এ। 

উল্টোদিকের ফ্ল্যাট থেকে প্রায়ই সাউন্ড বক্সে গানের আওয়াজ পাওয়া যায়। বিশেষ করে বৃহস্পতিবারগুলোতে। কখনো ধুম ধাড়াক্কা গান, কখনো দু:খী দু:খী নেশাগ্রস্ত গান। বেশিরভাগ সময়ই অবশ্য হিন্দি আইটেম গান বাজে। প্লেলিস্ট শুনে মানুষের মুড বোঝা খুব সহজ। প্রতিবেশী মনে হলো বেশ সুখী-পার্টি প্রিয় মানুষ। 

এ বাসায় ওঠার পর নতুন একটা জিনিসের ঝোঁক তৈরি হয়েছে। দরজা লাগানোর পর মোড়া নিয়ে দরজার গোড়ায় বসে থাকি। পাশের বাসার গান শুনি। অদ্ভুত আনন্দ হয়। এমন না-গান শোনা আমার নেশা, এমন না-আমার পর্যাপ্ত এক্যুপমেন্ট নেই। একটা এয়ারপড আর জেবিএল পড়ে আছে অনেকদিন ধরে। না চালাতে চালাতে এখন তারা জীবিত কিনা জানিনা।

তবু আমি দরজার ওপাশের গান পছন্দ করি। ইয়ারফোনে গান শুনলে মনে হয় কানের কাছে কেউ ঘ্যানঘ্যান করছে। ঘ্যানঘ্যানানি বেশিক্ষন সহ্য করা যায় না। এই সিস্টেমটা ভালো। দূর থেকে ভেসে আসা শব্দ-যা আমার কান পর্যন্ত আসার কথা না-তবু আসছে, যার তালে তালে আমার নাচার কথা না-তবু নাচছি। নিষিদ্ধ কিছুর আনন্দ হয় অত্যন্ত তীব্র। 

প্রতি বৃহস্পতিবার এইট বি এর সামনে অনেক জোড়া জুতা থাকে। বিভিন্ন সাইজের, ছেলেদের জুতা, মেয়েদের জুতা। প্রায় ৮-১০ জোড়া। সবাই মিলে এরা রাতভর আড্ডা দেয়। দারোয়ান শালা এদের দেখে না? 

মাঝে মাঝে ধুপধাপ শব্দ হয়। ওরা নাচে। আমিও দরজার এপাশ থেকে তালে তালে শরীর দুলাই। 

মাঝে মাঝে নিজের ভেতর পারভারসন আছে কিনা প্রশ্ন জাগে। তারপরেই জাস্টিফাই করি এই ভেবে, পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য সবকিছু করা যায়। এর আগে অবশ্য জেডি বা শিভাসে ছোট চুমুক দেই। পকেটের অবস্থা ঘনঘোর বর্ষা হলে কেরু। অনেকেই ভাবেন মেয়ে বলে ম্যানেজ করতে প্যারা হয়। আসলে হয় না।সাকুরার একটা ছেলে পরিচিত হয়ে গেছে। ফোন দিলেই চট করে হোম ডেলিভারি ডান।

লিফটে একদিন মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছে। এইট-বি এর মেয়েটা। একই দিন একই সাথে আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমেছি, সেখান থেকে অফিসে গিয়েছি। কোনো কথা হয়নি, জাস্ট চোখাচোখি, যাকে তুলনামূলক কম ক্লিশে শোনাতে বলা যায় ‘আইয়িং’। মেয়েটিও সম্ভবত সোশ্যাল অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত। কথা বলতে কিংবা সামান্য পরিচিত হতে যে একদম ইচ্ছা হয়নি, এমন ডাহা মিথ্যে কথা বলবো না। তবে আইস ব্রেকিং এর মতো কষ্টসাধ্য কাজের ইচ্ছা সকাল সকাল হলো না। 

এভাবে আরও বৃহস্পতিবার আসে, আমি ডোরহোলে জুতা গুণি, দরজার এপাশ থেকে গান শুনি, কোমর দুলাই।

শুধু এই বৃহস্পতিবার। এবার আমার কী যেন হলো। হোয়াই সাম পিপল হ্যাভ অল দ্য ফান? এইট বি এর সামনে তেরো জোড়া জুতা দেখে আমার সকল আনন্দ ঈর্ষার রূপ নিয়ে মাথা ও শরীরে ভর করলো। ঘামের মতো ঈর্ষায় শরীর ভিজে গেলো। 

ঝোঁকের ভেতর এমন একটা কাজ করলাম যা আগে কখনো করিনি। করবো বলে ভাবিও নি। আগেপিছে কোনো চিন্তা না করেই এইট বি-র কলিংবেলে চাপ দিলাম। দেবার পর অবশ্য লজ্জায় কুঁকড়ে  যাচ্ছিলাম। তার উপর অন্তত তেরোজন না হোক, অনেকেজনের উঁকিঝুকি দেখতে হবে এক ধাক্কায়। কী লজ্জা!

কাঁটায় কাঁটায় চার সেকেন্ডের মাথায় দরজা খুললো মেয়েটা। আড়াই সেকেন্ডের মাথায় আমি কলিংবেল টেপার কারণ দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। দরজা খোলামাত্রই গম্ভীর গলায় ভ্রু কুঁচকে বলবো, সাউন্ড কমান। খুব মাথা ধরেছে। 

মেয়েটা দরজা খুললো। 

বিশাল ড্রয়িং রুমে একটা টেবিল, একটা চেয়ার। মেঝেতে লাল রঙের তার্কিশ রাগ, আর্টিফিশিয়াল প্ল্যান্ট আর একটা ছোট আয়না। টি টেবিলের উপর জরাজীর্ণ স্পিকার রাখা, পাশেই কাঁচের গ্লাস। এদিক ওদিকে তাকিয়ে টের পেলাম ঘর জুড়ে অদ্ভুত মানবশূন্যতা। কেবল একজোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে। ভেতরেও কারো সাড়াশব্দ নেই। 

বাইরের জুতার দিকে তাকালাম আবার। ঠিক ঠাক দেখছি তো? তখনই মেয়েটি হাস্কি গলায় মাই ডিয়ার ভঙ্গিতে বললো,

‘ভেতরে আসুন না! পার্টি করছি, য়্যু মে জয়েন’

ভদ্রমহিলার বয়স কত হবে? ৩২ কি ৩৩। কথা বলার ধরন অদ্ভুত ম্যানিপুলেটিভ। ইতস্তত করতে করতেই ভেতরে ঢুকলাম। সে আমাকে কাঁচের গ্লাসে ভাগ দিলো। 

‘আমিও একাই থাকি। মাঝে মাঝে কিন্তু আসতে পারেন।’

মাথা নেড়ে জানালাম, ‘আচ্ছা’

প্রথম দশ মিনিট পিনড্রপ সাইলেন্স। গান নেই, ধুপ ধাপ শব্দ নেই, মুখে রা নেই। আমরা দুই জন মুখোমুখি বসে আছি। কিছুক্ষণের ভেতর আবিষ্কার করি, আমরা কথা বলছি। কনভারসেশন কীভাবে শুরু হয়েছিলো, স্টার্টার কে ছিলো আমার মনে নেই। স্মৃতি বলছে, আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছি সেদিন। যেমন, পাউরুটিকে স্লাইস করলে সে ব্যাথা পায় কিনা, মাছদের রাজনৈতিক দল আছে কি-না, কবুতর মেটিং এর সময় মোন করে কি-না ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমরা কেউই সে রাতে ঘুমালাম না। 

রাত ফুরায়, কথা ফুরায় না। এইট বি থেকে যখন এ তে যাই, তখন প্রায় সকাল। বের হবার সময় চোখে পড়লো বিশাল দৈত্য সাইজের শু র‍্যাক। মিনিমাম ২৫-৩০ জোড়া জুতা সেখানে। সব সাইজের জুতা, শিশু থেকে শুরু করে ছেলে, মেয়ে, ইউনিসেক্স। ইমেলদা মার্কোসের হাজার হাজার জুতা ছিলো। সে তুলনায় এখানে কমই, মাত্র ৩০ জোড়া। নি:শব্দে বেরিয়ে গেলাম। 

এ পর্যায়ে অনেকেই জেনারেল কিওরিওসিটি থেকে জানতে চাইবেন পরবর্তীতে আমরা বন্ধু কিংবা অন্য কোনো সম্পর্কে গিয়েছি কি-না। 

না, আমরা বন্ধু হইনি। 

মেয়েটার সাথে মাসে দুই-একবার লিফটে ওঠানামার সময় দেখা হয়। আমরা কেউ কারো সাথে কথা বলিনা, এমনকি চোখের দিকেও তাকাই না। ফলতঃ আইস ব্রেকিং হয়না। আমরা ফিরে যাই আমাদের যাপিত জীবনে। আবারও বৃহস্পতিবার আসে। আমি ডোরহোল দিয়ে দশ বারো জোড়া জুতা গুণি। ধুপধাপ নাচের শব্দের সাথে দরজার এপাশ থেকে আমিও কোমর দুলাই। 

Tags

33 Responses

  1. Hi Neat post Theres an issue together with your web site in internet explorer may test this IE still is the marketplace chief and a good component of people will pass over your fantastic writing due to this problem

  2. Your blog is a treasure trove of knowledge! I’m constantly amazed by the depth of your insights and the clarity of your writing. Keep up the phenomenal work!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *