আমি সারাজীবন মেয়ে হতে চেয়েছি ৷ দশ বারোটা সাধারণ মেয়ের সাথে আমার কোনো মিল নেই। মেয়েরা সাধারণত কোমল হয়, ক্ষেত্রবিশেষে ভীতু ,আহ্লাদী কিংবা সরল। গভীর রাতে একা একা বাড়ি পেরিয়ে পায়খানায় যেতে বুক কাঁপে, সিগারেটের গন্ধে পেট উল্টে বমি আসে , বাচ্চা দেখলে গাল টিপে দিতে ইচ্ছা করে, নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ দেখে চোখে পানি চলে আসে —এমন একজন মেয়ে হবার স্বপ্ন দেখেছি। 

আমি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোও না। মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বেশিরভাগ মানুষই থাকে ভীত। চোখে বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি নিয়ে মুখ খিঁচে যে কয়টা দিন বাঁচা যায়,তাতেই সিদ্ধিলাভ। চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই বুকে কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে । হুহু করে চক্রবৃদ্ধি হারে সকাল সন্ধ্যা সেই কষ্ট বাড়ে। আমার দলের মানুষ কম , কিংবা কমের কাছাকাছি , অথবা নেই বললেই চলে। কারণ মৃত্যুচিন্তা নিয়ে আমি সুখী। শুধু সুখী বলে থেমে গেলে ভুল হবে। আমি নিশ্চিত, এবং সুখী। আমি মারা যাবো আত্মহত্যা করে । যদি আত্মহত্যার মাঝে রোনাল্ড ওপাসের মতো মারা যাই, সেটা হবে ভিন্ন কথা। রোনাল্ড ওপাস দশ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়েছিলো স্যুসাইডের উদ্দেশ্যে, আট তলা বরাবর পৌঁছতেই এপার্টমেন্টের জানালা থেকে একটা গুলি এসে বিঁধে তার মাথা বরাবর। ব্যস! বেচারার সুইসাইড হয়ে গেলো হোমিসাইড…পরের কাহিনী অবশ্য আরও টুইস্টেড। এখন আর ওপাস ভাইয়ের কাহিনী লিখতে ইচ্ছে করছে না।

শেষ কয়েকদিন ধরে মৃত্যু পূর্ববর্তী একটা সুন্দর দৃশ্য আমি সাজিয়েছি । সেই দৃশ্য মনে ভাসতেই উত্তেজনায় আমার হাত পা কাঁপে। জীবনে প্রথম থ্রিলার সিনেমা দেখলে যেমন মুগ্ধতা জন্ম নেয়, কিছুটা তার কাছাকাছি ফিলিংস। ইদানীং আরেকটা সমস্যায়ও ভুগছি। ডাক্তার বলেছেন অ্যান্টেরোগ্রেড অ্যামনেশিয়া। নতুন তৈরি হওয়া স্মৃতিগুলো মনে রাখতে থাকছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। আজ দুপুরে কি দিয়ে লাঞ্চ করলাম সেটা মনে করতে পারছিনা, গতকাল আমাকে কে দেখতে এলো তা মনে করতে পারছিনা , কিন্তু ঠিকই আমার প্রথম প্রেমিক কবে, কোথায় আমাকে প্রথম চুমু খেয়েছে —সেটা মনে ভাসে।

ভেবে রেখেছি ২৫-২৮ বছরের মাঝামাঝি কোনো সময়ে আমি মারা যাবো। বিখ্যাত কে যেনো বলেছিলেন ,২৫ বছর বেঁচে থাকা এক জীবনের জন্য যথেষ্ট। এর বেশি বাঁচলে জীবনের উপর মায়া পড়ে ,কিংবা লোভ হয়। আমি লোভ কিংবা মায়ার জালে পড়তে চাইনা। আমার বয়স এখন ২৩ ,সেই হিসেবে আমি খুব বেশিদিন বেঁচে নেই। খুব ইমার্জেন্সি না হলে আত্মহত্যার জন্য আদর্শ সময় বিকেল । বিকেলগুলো জন্মগতভাবেই বিষণ্ণ। এই বিষণ্ণতা বৃত্তের মতো। বের হয়ে আসার জন্য কোনো ছিদ্র নেই । আমার রুমমেট সারাহ অবশ্য কোনো বিকেল জেগে থাকতে পারে না। সুতরাং, এই অতিরিক্ত বিষণ্ণতাও তাকে স্পর্শ করেনা। যদি ওকে জিজ্ঞেস করা হয় বিকেলগুলি দেখতে কেমন কিংবা বিকেলবেলা কি ঘটে, আমি নিশ্চিত সে দু এক লাইন বলার পর আটকে যাবে। কারণ এই ব্যাপারে তার কোনো প্র্যাক্টিক্যাল নলেজ নেই । হয়তো গল্প উপন্যাস থেকে কোনো বিকেলের বিবরণ আপনাকে বানিয়ে বানিয়ে বলবে , কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার মুখ থম্থম করবে। কারণ সে খুব বেশিক্ষণ বানিয়ে বানিয়ে কথাও বলতে পারেনা।

দুপুরের একটু পর থেকে ওর চোখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে আসে। ছোটোবেলা থেকেই নাকি এমন হয়। মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয় ওর শরীরে রিমোট কন্ট্রোলিং এর মতো কোনো ব্যাপার আছে। বিকেল হলেই সেটা এক্টিভেট হয়ে শরীরকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। একবার আমাদের লাঞ্চ করতে একটু দেরি হয়ে গেলো । সেদিন আমরা হোস্টেলেই ছিলাম । এক রুমে দু’জন থাকি। দোতলার ২০৬ নাম্বার রুম। বুয়া দুটো লাঞ্চ বক্স দিয়ে গেলো। সেখানে ছিলো ফার্মের মুরগীর হৃষ্টপুষ্ট দুটো রান , আলু-বরবটি ভাজি , আর মুগের ডাল। প্রায় বিকেলই বলা যায় । সূর্যের আলো নরম হয়ে এসেছিলো । স্পষ্ট মনে আছে , প্রচন্ড ক্ষুধায় গোগ্রাসে আমি খাবার গিলছিলাম । এরমধ্যে সারাহ একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটালো । এরজন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না । বিছানায় বসে সাদা দেয়ালে হেলান দিয়ে খাচ্ছিলো সে । অভ্যাসবশত তার দিকে তাকাতেই দেখি সে মুরগীর রান মুখে ঢুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চিৎকার করে অনেকক্ষণ হাসলাম , তার ঘুম ভাঙলো না । শেষে ধাক্কা দিয়ে মুখে এক মগ পানি ঢালার পর ঘুম ভাঙলো। খুব স্বাভাবিকভাবে রানটা চিবিয়ে আধা গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে আবার ঘুম দিলো। মাঝে যেন কিছুই হয়নি।

এই গল্পটা অনেকজনকে বলেছি। কয়েকজন অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে হেসেছে। মাঝেমাঝে হাসি পারিশ্রমিকের মতো কাজ করে । কেউ একজন উদ্যম নিয়ে কোনো হাসির গল্প বলার পর ভালো না লাগলেও হাসতে হয়। গল্প শুনে হাসি পেয়েছে , এমন না। কষ্ট করে গল্প বলার জন্য হাসিটা এখানে তার পুরষ্কার। সান্ত্বনা পুরষ্কার। তারা হয়তো আমাকে পারিশ্রমিক অথবা পুরষ্কার দিতে চেয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করেনি। তাদের কেউ কেউ আমাকে পাগল ভাবে। আমার খুব হাসি পায়। অথচ ওরা জানেই না বিশ্বাস নিয়ে ওদের অসংখ্য ভুল ধারণা আছে । অতীতে যা ঘটেছে এবং বেশিরভাগ মানুষ যা করছে , সেটাকেই শুধু ওরা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করে। সারাহ’র গল্পটা অবশ্য তিন-চার জন বিশ্বাস করেছে । তাদের চোখেমুখে সেটা আমি দেখেছি। মারা যাবার আগে আরেকটা এক্সট্রা কাজ যোগ হয়েছে। সেই চার পাঁচজনকে খুঁজে বের করে জানাতে হবে যে কাহিনীটা মিথ্যা ছিলো। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার জন্য আমি দুঃখিত। সারাহ নামে আমার কখনোই কোনো রুমমেট ছিলো না।

.

মৃত্যুদিন হিসেবে আমি বেছে নিতে পারি কোনো বর্ষণমুখর সন্ধ্যাকে। ‘বর্ষনমুখর সন্ধ্যা’- শব্দগুলো লিখতে যেয়ে ছোটবেলার কথা মনে পড়লো। বাংলা ২য় পরীক্ষাগুলোতে প্রায়ই এই রচনা আসতো। আমি কখনো রচনা মুখস্থ করিনি ,পরীক্ষার হলে বানিয়ে বানিয়ে লিখতাম। সেজন্য অনেক মার খেতাম মায়ের কাছে । এখন আমার মা শিশুর সৃজনশীল শিক্ষার প্রসার ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহন করে , লম্বা জোরালো বক্তৃতা দেয় । আমি চুপচাপ থাকি। বাসায় থাকার সময় প্রায়ই উচ্ছ্বসিত গলায় ‘দারূণ স্পিচ দিয়েছো তো ! ‘ বলে জড়িয়ে ধরেছি । পুরান ময়লা ঘাটার শক্তি আমার আর নেই।

বরং আমি সেদিনের গল্পে ফেরত যাই ৷ সকাল থেকে সেদিন এলোপাথাড়ি বৃষ্টি পড়বে। মানুষকে রোমান্টিক করে দেয় কিংবা কানে রবীন্দ্রসংগীত গুঁজতে বাধ্য করে-এমন বৃষ্টি নয় । হিংস্র ধরণের বৃষ্টি। বাতাস উড়িয়ে নিতে চাইবে সবকিছু , ঘরের দরজাগুলো ধুমধাম বাড়ি খাবে ,টেবিলের উপর থেকে জিনিসপত্র টপটপ করে পড়তে থাকবে। জানালার ধারে থাকা আমার বিছানার কিছু অংশ ভিজে ততক্ষণে জবুথবু। জানালার গ্লাস লাগাতে লাগাতে দেখবো আকাশে চির ধরছে উজ্জ্বল আলোয় । বিকট শব্দে কান তালা লেগে আসতে চাইবে । তবুও সেদিন আমার কোনোকিছুই খারাপ লাগবে না।

আমি কোনো বসন্তকালও বেছে নিতে পারি। বৃষ্টির দিনগুলো সাধারণত খুব স্যাঁতসেঁতে হয় । অনেকদিন গোসল না করলে শরীরে যেমন চ্যাপ্টা ঘামের গন্ধ হয় ,তেমন । এমন গুমোট দিনে আমি সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাইনা । বরং সেটা হতে পারে বসন্তের কোনো পূর্ণিমা রাত। সেই স্ফটিক আলোতে ফিনফিনে সাদা শাড়ির ভেতর দিয়ে মেয়েদের নাভি দেখার মতো মতো আমি পৃথিবী দেখবো। সেদিনের ঝিরঝির বাতাসে পৃথিবীর প্রাণিদের অর্ধেক দুঃখ কষ্ট ভেসে যাবে,বাকি অর্ধেক যাবে চাঁদের আলোয়। আমি থাকবো ভীষণ স্বাভাবিক। পরিচ্ছন্ন মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি প্রথমে গোসলে যাবো। এরপর সাধারণত আমি গ্রিন টি খাই। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হবে না।

.

আমার একটা হলুদ রঙের ছোট সাউন্ড বক্স আছে। সেকেন্ড হ্যান্ড। ২০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। সেকেন্ড হ্যান্ড হলেও সাউন্ড কোয়ালিটি খুব ভালো। জানিনা কেনো সাউন্ড বক্সটা আমার ভীষণ প্রিয়। সাউন্ড বক্সে সেদিন সন্ধ্যা থেকে বাজতে থাকবে বিথোভেনের ‘ফ্যর এলাইজা(Fur elise)

ইংরেজিতে ‘ফর এলিজ’, বাংলায় এলিজের জন্য। এটা কোনো গান না , স্রেফ কিছু পিয়ানো নোট। পিয়ানিস্ট বিথোভেন থেরেসা নামের একটি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে নোটগুলো লিখেছিলেন । তিনি মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। হাতের লেখা খারাপ হওয়ায় ট্রান্সক্রিপটর Fur theresa কে Fur elise বানিয়ে দিলো । থেরেসা নামের মেয়েটি শেষ পর্যন্ত বিথোভেনকে বিয়ে করতে রাজি হননি। থেরেসা যদি বুঝতে পারতেন বিথোভেন তাকে কি অমূল্য জিনিস উপহার দিয়েছেন, আমার ধারণা তিনি রাজী হতেন। 

আমি সাধারণত একজন সুখী মানুষ। এতটাই সুখী যে ,মাঝেমাঝে মনে হয় জীবন থেকে পাবার মতো আর কিছু বাকি নেই। কিন্তু যতবার আমি ‘ফ্যর এলিজা’ শুনি, আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। জানিনা হঠাৎ করে কোথা থেকে মেঘের মতো লক্ষ লক্ষ কষ্ট উড়ে আসে। প্রথমে আমার মাথায়, এরপর পুরো শরীরে। পিয়ানোর নোটগুলো আমার শিরায় শিরায় দৌড়ে বেড়ায়। নোটগুলো আমাকে ক্রমাগত শুষে নেয়। তখন আমার খুব কষ্ট হয়। মরে যেতে ইচ্ছা করে। জানিনা এরকম আর কারো হয় কিনা , আমার হয়। এমনিতে আমার কোনো কষ্ট নেই । শুধু ঐ সময়টুকু আমার বুকটা খাঁ খাঁ করে। পৃথিবীর সব মানুষের কষ্ট আমার মনে ভর করে। এই ভরেই আমি হয়তো মারা যাবো।

আমি একটা আনন্দদায়ক মৃত্যু চাই । পেইনলেস ডেথ হলে আরও ভালো। গলায় দড়ি দেওয়া কিংবা দুইশো ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিৎ হয়ে মরে পড়া থাকা ভীষণ অশ্লীল ব্যাপার। যেতে হবে সুন্দর করে , রাজকীয়ভাবে, অভিনব কায়দায়। সুযোগ থাকলে আমি হেমলক চাইতাম। এখানে হেমলক পাওয়া যায়না। সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছিলো হেমলক পানে। তাঁকে বলা হয়েছিলো, পেয়ালার বিষ এমনভাবে পান করতে যাতে এক ফোঁটা বিষও পেয়ালার বাইরে না পড়ে। সক্রেটিস ধীরস্থিরভাবে এক চুমুকে সবটুকু বিষ পান করেন। এরপর তাকে নির্দেশ দেয়া হল, রুমের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করার জন্য, যাতে করে বিষ সমস্ত শরীরে ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমি হেমলকের প্রক্সি চিন্তা করেছি। রক্ত করবী। রক্ত করবী গাছের প্রতিটা অংশই ভীষণ বিষাক্ত। আমার গ্রিন টি’র সাথে মেশানো থাকবে রক্তকরবীর নির্যাস। আমাকে যদিও আদেশ দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না , আমি নিজেই নিজেকে আদেশ দিবো।

ঐন্দ্রিলা, পুরো চা টুকু খাও। এরপর হাঁটাহাঁটি করো ‘

কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর আমি বিছানায় চলে যাবো, সুড়সুড় করে কাঁথার নিচে গিয়ে ভেজা চুলগুলো মেলে দিবো। তখন হয়তো আমার কান্না আসবে, চোখের দু’পাশ থেকে পানি গড়িয়ে পড়বে, কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করবে, এমনকি অল্পক্ষণের জন্য বাঁচতেও ইচ্ছা করতে পারে। তবুও আমি যেতে চাই , আমি যেতে চাই ।

১২ জানুয়ারি ,১৯৯৬

(রাজধানীর একটি সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ডে ‘ঐন্দ্রিলা সরকার’ নামের একজন রোগীর ডায়েরী হতে সংগৃহীত। ঐন্দ্রিলা ১৫ জুন, ২০০২ সালে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে মারা যান। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিলো ২৯ বছর। শেষদিকে শারীরিক এবং মানসিক অবনতির কারণে তাকে হাসপাতালের বিছানার সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো)

Tags

12 Responses

  1. Keep up the fantastic work! Kalorifer Sobası odun, kömür, pelet gibi yakıtlarla çalışan ve ısıtma işlevi gören bir soba türüdür. Kalorifer Sobası içindeki yakıtın yanmasıyla oluşan ısıyı doğrudan çevresine yayar ve aynı zamanda suyun ısınmasını sağlar.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *